


এক সময়ের সবুজ অরণ্য ঘেরা দীঘিনালা এখন প্রায় বৃক্ষশূণ্য হয়ে পড়েছে। মাইনী নদী অববাহিকায় ছোট-বড় অসংখ্য পাহাড় ও টিলা নিয়ে গড়ে ওঠা এই জনপদ এখন অরণ্য হারিয়ে বিরান ভূমিতে পরিণত হচ্ছে। ক্রমাগত সংরক্ষিত বনাঞ্চল উজাড় করছে একটি চক্র।
বন বিভাগের অপরিমেয় উদাসীনতা ও ঘুষ বাণিজ্যের কারণে দিন-দুপুরে এসব দুর্গম পাহাড় থেকে কেটে সরবরাহ করা হচ্ছে সংরক্ষিত বনের কাঠ। চলতি মৌসুমে অন্তত ৫ লাখ ঘনফুট কাঠ দীঘিনালার বিভিন্ন পাহাড়ি বন থেকে উজাড় হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। প্রতিদিন প্রকাশ্যে বেআইনীভাবে চাঁদের গাড়ি (জীপ) করে বিভিন্ন বাণিজ্যিক কাজে বনের কাঠ পরিবহন করলেও নিরব ভূমিকা পালন করছে বন বিভাগের কর্মকর্তারা। শুষ্ক মৌসুম অর্থ্যাৎ এপ্রিল-মে পর্যন্ত এভাবেই কাঠ পরিবহন চলবে, সাবাড় করা হবে প্রাকৃতিক বন। আমাদের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন জানা গেছে জনাব মোঃ ফরিদ মিঞা নেতৃত্বে
খাগড়াছড়ির দীঘিনালা, বন বিভাগে ঘুষ বানিজ্য হচ্ছে
এবং রাঙামাটির লংগদু উপজেলা এবং সাজেক ইউনিয়নের অংশে পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগ এবং ঝুম নিয়ন্ত্রণ বন বিভাগের ছয়টি রেঞ্জ রয়েছে। এরমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের আওতায় নারাইছড়ি রেঞ্জ, মারিশ্যা রেঞ্জ, বাঘাইহাট রেঞ্জ এবং ঝুম নিয়ন্ত্রণ বন বিভাগের আওতায় হাজাছড়ি রেঞ্জ, লংগদু উল্টাছড়ি রেঞ্জ এবং মেরুং রেঞ্জের কাঠ পাচার রোধে রয়েছে জামতলী চেক স্টেশন। তবে এই স্টেশন কর্মকর্তার প্রশ্রয়ে এবং অন্যান্য ছয়টি রেঞ্জের কর্মকর্তার ঘুষ৷ বাণিজ্যে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বন খেকোরা।
জামতলী চেক স্টেশনের সামনে দিয়ে প্রতিদিন অসংখ্য কাঠ বোঝাই জীপ আসা যাওয়া করে। এসব কাঠ যাচ্ছে অবৈধ ইটের ভাটা ও তামাক চুল্লিতে। এ ছাড়া জোতের ক্ষেত্রেও প্রতিদিন পারমিটের চেয়েও দেড় গুণ কাঠ পাচার হচ্ছে সমতলে। প্রশাসনের নাকের ডগা প্রতিটি ট্রাকে পারমিটের বেশি কাঠ পাচার হলেও কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সরেজমিনে বন উজাড়ের পরিস্থিতি দেখতে উপজেলার হাজাপাড়া, নয়মাইল, সীমানা পাড়া, মায়াফাপাড়াসহ বিভিন্ন পাড়ায় যায় এই প্রতিবেদক। উপজেলা সদর থেকে অন্তত ৮ কিলোমিটার দূরের গ্রাম বিষ্ণুকার্বারী পাড়া। পাড়া থেকে আরো ৫ কিলোমিটার দূরে গিয়ে যায় গভীর দুর্গম পাহাড়ও উজাড় হচ্ছে।
সদ্য কাঠ কাটা হয়েছে এমন কয়েকটি পাহাড়ও চোখে পড়ে। স্থানীয়রা জানান, ‘মূলত জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করার জন্য এসব পাহাড় থেকে কাঠ কাটা হচ্ছে। মূলত যেসব গাছ প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে উঠেছে সেগুলো জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। এতে পুরো পাহাড়টি বৃক্ষশূণ্য হয়ে পরে। ছোট বড় সব ধরনের গাছ কেটে নিয়ে যায় শ্রমিকেরা। মূলত দুর্গম হওয়ায় চাঁদের গাড়িতে করে এসব কাঠ পরিবহন করা হয়।’নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শ্রমিকেরা জানান ,‘আমরা মূলত দৈনিক শ্রমিক হিসেবে পাহাড় থেকে গাছ কাটার কাজ করি।
বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোঃ ফরিদ মিঞা কাছে থেকে
তৃতীয় একটি পক্ষ পাহাড়ের থেকে চুক্তির ভিত্তিতে পাহাড়ে সব গাছ কিনে নেয়
তারপর গাছ কেটে তা বিভিন্ন ইটভাটায় সরবরাহ করা হয়।’
চাঁদের গাড়ি বা জীপের শ্রমিকেরা বলেন,‘অনেক দুর্গম এলাকা থেকে কাঠ আনা হয়। দিনে দুবারের বেশি আসা যাওয়া সম্ভব হয় না। ’
দুর্গম পাহাড় থেকে কেটে আনা সেসব কাঠ বন বিভাগের নাকের ডগায় পরিবহন করা হয়। কাঠ পাচার বা পরিবহরে প্রধান রুট খাগড়াছড়ি -দীঘিনালা সড়কের জামতলী এলাকা। অথচ জামতলীতেই পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের আওতাধীন নাড়াই রেঞ্জ, ঝুম নিয়ন্ত্রণ বিভাগের চেক পোস্টও রয়েছে। এছাড়া উপজেলার থানা বাজার হয়ে বোয়ালখালি বাজার সড়ক হয়ে এসব কাঠ ইট ভাটায় নিয়ে যাওয়া হয়। বছরের ৮ মাস এভাবে বনজ কাঠ পরিবহন করা হয়
জামতলী চেক স্টেশনের স্টেশন কর্মকর্তা মো. শাহীন মিয়ার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি এখানে একমাস আগে যোগদান করেছি৷ আমরা আমাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছি এখানে যা কিছু হচ্ছে সবকিছু বিভাগীয় মূল কর্মকর্তা নেতৃত্বে হচ্ছে
এবং এখানে কোনো অনিয়ম হচ্ছে না। যোগদানের পর একটি গাড়ি আটক করেছি এবং মামলাও হয়েছে।’
পার্বত্য এলাকায় সংরক্ষিত বন, রক্ষিত বন, ব্যক্তিমালিকাধীন বন ও অশ্রেণীভুক্তসহ চার ধরনের বন রয়েছে। তবে গত কয়েক দশকে এসব সংরক্ষিত বনাঞ্চল ব্যাপক হারে উজাড় হয়েছে। বনখেকোদের দৌরাত্ম্যে এসবে বনের কাঠ নির্বিচারে কাটা হচ্ছে
সাধারণ পার্বত্য এলাকায় গাছ কাটতে হলে সরকারিভাবে অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু নজরদারি ও তদারকির অভাবে জোতের পারমিটের পাশাপাশি বিনা অনুমতিতেও বন গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে বনখেকোরা। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে বনাঞ্চল উজাড়ের তথ্য।
খাগড়াছড়ির দীঘিনালা ও পানছড়ি উপজেলার সীমান্তবর্তী সীমানাপাড়া এলাকা। পাড়া থেকে প্রায় এক ঘন্টা হাঁটার পর বন খেকোদের দেখা মিলল। যেতে যেতে চোখে পড়ে বনের গাছ পরিবহন করার জন্য পাহাড় কেটে রাস্তা করা হয়েছে। বন ধ্বংস হওয়ায় বিপন্ন হচ্ছে পশু পাখির আশ্রয়স্তল । বিনষ্ট হচ্ছে জীবজগত। বন মাটি নির্মল রাখে,পানির উৎস সতেজ রাখে এবং মাটির ক্ষয় রোধ করে। দুর্গম পাহাড় থেকে সহজে গাছ পরিবহনের জন্য পাহাড় কেটে রাস্তা বানায় বনখেকোরা। বনের গাছ কর্তন রোধে কঠোর পদক্ষেপ চায় পরিবেশ কর্মীরা।
পিটাছড়া বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ উদ্যোগের প্রতিষ্ঠা মাহফুজ রাসেল বলেন, ‘অনুমতি ছাড়া অশ্রেণীভুক্ত বনের গাছ কাটার কোন নিয়ম নেই। কিন্ত খাগড়াছড়িতে নির্বিচারে বন কর্তন হয়। কোন বাধা ছাড়া বন উছাড় হচ্ছে। বন বিভাগ কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না। তাদের নাকের ডগায় প্রতিনিয়ত বনের কাঠ পরিবহন করা হচ্ছে।’
বন বিভাগের নাড়াইছড়ি রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা মতিউর রহমান বলেন, ‘চলতি মৌসুমে আমরা দুইটা গাড়ি জব্দ করেছি।’ কাঠ পাচার বন্ধে কেন কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না এমন প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান তিনি।’
তবে নিজেদের অপরাধ ঢাকতে তামাক চাষীদের ওপর দোষ চাপালেন পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘ব্যাপক হারে তামাক চাষ হওয়ার কারণে বৃক্ষ নিধন রোধ করা যাচ্ছে না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঝুম নিয়ন্ত্রণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তাকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। বিস্তারিত আরও জানতে আমাদের সাথে থাকুন